আলহাজ্ব মাওলানা ছৈয়দ আখতার কামাল শাহ্ :
আলা হযরত গাউছে মোকাররম, শাহে দো আলম, হাজত রাওয়া, মুশকিল কোশা, শাহ্ছুফী হাফেজ মাওলানা ছৈয়দ নজীর আহমদ শাহ্ আল মাইজভান্ডারী (কঃ) বার আউলিয়ার পূণ্যভূমি চট্টগ্রাম জেলার পটিয়া থানার (বর্তমান কর্ণফুলী থানা) অন্তর্গত জুলদা গ্রামে স্বনামধন্য মুনছুর আলী চৌধুরী বাড়ীর সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে মরহুম মোহাম্মদ আছদ আলী চৌধুরীর ঔরষে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি মরহুম আছদ আলী চৌধুরীর চার পুত্র সন্তানের মধ্যে ২য় পুত্র ছিলেন। ২২ রবিউস ছানী ১৩১৬ হিজরী, ৩ আশ্বিন ১৩০২, ১২ জুন ১৮৯৬ ইংরেজী, রোজ সোমবার ছোবহে ছাদেক। এই মহান অলি ৬৩ বৎসর বয়সে, ১৫ রজব ১৩৮৯ হিজরী, ২৯ পৌষ ১৩৬৫ বাংলা, ১৩ জানুয়ারী ১৯৬০ ইংরেজী রোজ বৃহস্পতিবার দুপুর ১টা ৩০ মিনিটে অগনিত ভক্ত, অনুরক্ত ও আশেকানদের ছেড়ে পরম মাসুকে হাকিকির নিকট বেছাল প্রাপ্ত হন (ইন্না লিল্লাহে………রাজিউন)। হযরত নজীর ভান্ডারী (কঃ) তাঁহার পিতা-মাতা ও ভাই-বোনদের সাথে একটি আদর্শ পারিবারিক পরিবেশে বড় হয়ে উঠেন। বাল্যকালে তিনি বাড়ীর বা এলাকার অন্য সকল ছেলেদের তুলনায় ভিন্ন স্বভাবের ছিলেন। একাগ্রতা, শিষ্টাচারিতা, সদালাপিতা ও অধ্যবসায় ইত্যাদি তাঁহার চরিত্রে শোভা পেতো। পাশাপাশি তিনি লেখা পড়ায়ও মনোনিবেশ করেন।
তিনি এতই মেধাবী ছিলেন যে, মাত্র ৯ বছর বয়সে পবিত্র কালামউল্লা শরীফ মুখস্থ করিতে সক্ষম হন। ১৪ বছর বয়সে মসজিদে খতমে তারাবির নামাজের পবিত্র দায়িত্বভার গ্রহণ করেন এবং ঈমাম নিযুক্ত হন। স্থানীয় প্রাইমারী স্কুলে প্রাথমিক শিক্ষা শেষে উচ্চতর শিক্ষার জন্য তিনি চট্টগ্রাম শহরে আসেন এবং পশ্চিম মাদারবাড়ী নিবাসি বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ রশিদ মাষ্টারের বাড়িতে জাগির থাকা শুরু করেন। তদ্বকালিন সময়ের বিশিষ্ট আলেমেদ্বীন, বাহারুল উলুম, হযরত মাওলানা মোহাম্মদ নাজের শাহ (রা:) (বর্তমানে হযরত গরিব উল্লাহ শাহ্ (রা:) এর মাজারের সামনে তাঁহার মাজার শরফি অবস্থিত) এর ব্যবস্থাপনায় পরিচালিক সরকারি মোহছেনিয়া মাদ্রাসায় তিনি ভর্তি হন। হযরত নজীর ভান্ডার (ক:) তাঁর মেধা, অধ্যবসায় ও সৎ চরিত্রের কারণে হযরত নাজের শাহ (রা:) ও অন্যান্য মোদাচ্ছেরগণের বিশেষ দৃষ্টি আকর্ষণ করিতে সমর্থ হন। তিনি আরবী, উর্দু ও ফার্সী ভাষায় বিশেষ পারদর্শিতা অর্জন করেন। ইলমে শরিয়তে পরিপূর্ণ জ্ঞান অর্জনে উদ্দেশ্যে ফিকাহ্, নাহু, ছরফ ও মানতেক বিষয়ে গভীরভাবে অধ্যয়ন করেন। মোহছেনিয়া মাদ্রাসায় শিক্ষা শেষে তিনি ইলমে তফছির ও ইলমে হাদিস শরীফের উপর স্নাতক ডিগ্রি লাভের উদ্দেশ্যে আরো ১০ জন সহপাঠীসহ এই উপমহাদেশের তদ্বকালীন সর্বোচ্চ ইসলামি বিদ্যাপীঠ কলকাতা আলিয়া মাদ্রাসায় গমন করেন। সেখানে তিনি দীর্ঘ ৫ বছর ইলমে তফছির ও ইলমে হাদিস শরীফের উপর অধ্যয়ন করেন। অকুতোভয় যুবক হযরত নজীর ভান্ডারী (কঃ) কোরআন শরীফ, হাদিস শরীফ, ইজমা, কেয়াস, ফেকাহ, নাহু, ছরফ, বালাগাত, মানতেক সহ সর্ববিষয়ে যেমন পারদর্শিতা অর্জন করেন, তেমনি ইলমে ফরায়েজ ও ইলমে সিফা তথা হেকিমি বিদ্যায়ও সমান পারদর্শিতা লাভ করেন।
হযরত নজীর ভান্ডারী (ক:) পর পর সর্বমোট চারটি বিবাহ করেন। প্রথম স্ত্রীর নাম জানা নাই। তাঁহার গর্ভে একটি মাত্র কন্যা সন্তান ছিল। নাম- মরহুমা ছৈয়দা আমাতুন নুর বেগম। প্রথম স্ত্রী ইন্তেকাল করিলে চট্টগ্রাম ডবলমুরিং থানার অন্তর্গত পাঠানটুলী কাপুড়িয়া পাড়াস্থ হযরত মাওলানা শাহ ছুফী ছৈয়দ আমানত উল্ল্যা শাহ্ আল মাইজভান্ডারী (র:) এর কনিষ্ঠ কন্যা মোছাম্মৎ ছৈয়দা আছমা খাতুন কে (র:) তিনি দ্বিতীয় বিবাহ করেন। তাঁহার উক্ত দ্বিতীয়া স্ত্রী আরবী শিক্ষায় শিক্ষিতা এবং ইনছানে কামেলা ছিলেন। হযরত আছমা খাতুনের গর্ভে তিনটি কন্যা সন্তানের জন্ম হয়। যথাক্রমে ১। মরহুমা ছৈয়দা রাজারিয়াতুন নুর বেগম। যিনি শৈশবকালে ইন্তেকাল করেন। ২। মরহুমা ছৈয়দা জিয়াততুন নুর বেগম। ৩। মরহুমা ছৈয়দা সাজেদাতুন নুর বেগম। বিশেষ এক পর্যায়ে হযরত নজীর ভান্ডার ২য় স্ত্রীর অনুরোধে তৃতীয় বিবাহ করেন এবং শেষোক্ত স্ত্রীকে বিবাহের ১ বৎসরের মধ্যে মোহরানা সমেত বিদায় করেন। হযরত ছৈয়দা আছমা খাতুন (র:) (২য় স্ত্রী) আধ্যাত্মিক সাধন ভজনে অনেক উচ্চস্তরে উপনীত হওয়ায় তিনি সংসার জীবন থেকে দূরে থাকতে পছন্দ করতেন। যেহেতু তাঁহাদের কোন পুত্র সন্তান ছিল না সেহেতু পুত্র সন্তানের প্রয়োজনীয়তার কথা চিন্তা করে তিনি তাঁর স্বামীকে অনেক অনুরোধ করিয়া চট্টগ্রাম জেলার চাদগাঁও থানার অন্তর্গত হযরত মাওলানা শাহছুফী ছৈয়দ আবদুল কাদের শাহ আল মাইজভান্ডারীর কনিষ্ঠ কন্যা মোছাম্মৎ ছৈয়দা জেবুননিছা বেগম (র:) কে ৪র্থ স্ত্রী রূপে বিবাহ করান। উক্ত স্ত্রীর গর্ভে তিন শাহজাদা ও এক শাহজাদী জন্মগ্রহন করেন। তবে মেজ শাহজাদা ৪ বৎসর বয়সে ইন্তেকাল করেন।
মোমেনের চরিত্রের একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য হইতেছে আমানত রক্ষা করা। আমানত বিভিন্ন প্রকার হইয়া থাকে। ১ নং- কাহারো গচ্ছিত সম্পদ কিংবা টাকা-পয়সা চাহিদা মোতাবেক ফিরাইয়া দেওয়া। ২ নং- ওয়ারিশানগণের মধ্যে সঠিকভাবে স্থাবর অস্থাবর সম্পত্তির বন্টন করা। ৩ নং- অন্যের গোপনীয়তা রক্ষা করা। উপরোল্লেখিত সকল আমানতের হেফাজতকারী রূপে হযরত নজীর ভান্ডারী (ক:) ছিলেন দিনের সূর্যের ন্যায় প্রজ্বলিত (আল-হামদুলিল্লাহ)। স্মরণ রাখা উচিত যে, তরীকায়ে মাইজভান্ডারীরয়া খিজরি বেলায়েতের অন্তর্ভূক্ত। উক্ত খিজরি বেলায়ত তরীকায়ে মাইজভান্ডারীয়ার অন্তর্ভুক্ত থাকায় এই তিরকায় অনেক কাজকর্ম দৃশ্যত: শরিয়ত বিরোধী মনে হলেও আসলে তা নহে। সে যুগের অনেক আলেম উলামাগণ মাইজভান্ডারী তরিকার বিরোধীতা করিয়াছেন, বর্তমানেও করিতেছেন। এমন বিরোধীতাকারী অনেক আলেমগণ হযরত গাউছুল আজম মাইজভান্ডারী (ক:) সাথে মোনাজেরা করতে গিয়া তাঁহার গাউছিয়াতের আলোতে আলোকিত হয়ে ইনছানে কামেল হয়েছেন। হযরত নজীর ভান্ডার (ক:) ও বিরোধীকারী আলেমদের মধ্যে একজন ছিলেন এবং পরবর্তীতে তিনিও হযরত গাউছুল আজম মাইজভান্ডারী (ক:) এর গাউছিয়াতের আলোতে আলোকিত হয়েছেন। একদা হযরত নজীর ভান্ডার (ক:) রেঙ্গুন থাকাকালীন অবস্থায় সেখানে চট্টগ্রাম শহরের পাঠানটুলী চাটশ্বরাই গায়েবি মসজিদ এলাকার এক পূর্ব পরিচিত লোক তাঁহার শরনাপন্ন হন এবং আরজ করিলেন- আমি মানত করিয়াছি বাড়িতে গিয়া আপনার মাধ্যমে আমার বাড়িতে পবিত্র মিলাদ মাহফিল উদ্যাপন করিব। আপনি দয়া করে দাওয়াত কবুল করিবেন কি? হযরত নজীর ভান্ডার (ক:) দাওয়াত কবুল করিয়া তাহাকে দিন তারিখ নির্ধারিত করে দিলেন। উভয় জনে স্বদেশে আসার পরে যথা সময়ে ছাহেবে দাওয়াতের বাড়িতে আসিয়া হযরত নজীর ভান্ডার (ক:) উপস্থিত হয়েছেন। যথা সময়ে ওয়াজ মাহফিল শুরু হয়ে গেল। উক্ত মাহফিলে ধর্মপ্রাণ অনেক ব্যক্তি উপস্থিত ছিলেন। তন্মধ্যে অত্র এলাকার বিশিষ্ট আলেম হযরত মাওলানা ছৈয়দ আমানত উল্ল্যাহ্ শাহ আল মাইজভান্ডারী (র:) উপস্থিত ছিলেন। হযরত নজীর ভান্ডার (ক:) ওয়াজ নছিয়ত, আদব আখলাক দেখিয়ে হযরত মাওলানা ছৈয়দ আমানত উল্ল্যাহ্ শাহ মোলাকাত করিয়া পরদিন সকালে নাস্তার দাওয়াত দিলেন এবং হযরত নজীর ভান্ডার (ক:) উনার দাওয়াত সাদরে গ্রহন করিলেন। পরদিন সকালে পরিচয় মাওলানা ছৈয়দ আমানত উল্ল্যাহ্ শাহ্ (র:) হযরত নজীর ভান্ডার (ক:) যাবতীয় পরিচয় গ্রহন করেন এবং এক পর্যায়ে মাওলানা ছৈয়দ আমানত উল্ল্যাহ্ শাহ (র:) ছাহেব তাঁহার কন্যার সাথে হযরত নজীর ভান্ডার (ক:) বিয়ের প্রস্তাব করেন। প্রসঙ্গত মাওলানা ছাহেবের উক্ত কন্যা আলেমা ছিলেন। উক্ত প্রস্তাবের ব্যাপারে হযরত নজীর ভান্ডার (ক:) কোন প্রকার মন্তব্য না করিয়া এই ব্যাপারে তাঁহার বড় ভাইয়ের সাথে যোগাযোগ করিবার পরামর্শ দেন। উক্ত বড় ভাইয়ের নাম মরহুম নুরুজ্জামান আহমদ। সেখান থেকে বিদায় নিয়া আসার পূর্ব মূহুর্তে তাঁহার বাড়ির নাম-ঠিকানা লিখিয়া দিলেন। ২/৩ দিন পরে হযরত ছৈয়দ আমানত উল্ল্যাহ্ শাহ্ (র:) পশ্চিম পটিয়া থানার জুলদা গ্রামের মরহুম মুনছুর আলি চৌধুরী বাড়িতে আসিয়া উপস্থিত হইলেন। যথাযথ মেহমানদারীর পরে মরহুম নুরুজ্জামান আহমদ মেহমানের আগমনের কারণ জানিতে চাহিলে তিনি তাঁহার মেয়ের সাথে হযরত মাওলানা ছৈয়দ নজীর আহমদ শাহ্ আল্ মাইজভান্ডারী (র:) এর বিয়ের প্রস্তাব উত্থাপন করেন। তখন মরহুম নুরুজ্জামান আহমদ দেরি না করিয়া মেহমানের সাথে পাঠানটুলী কাপুড়িয়া পাড়াস্থ কনের পিত্রালয় আসিয়া কনে দেখেন। অত:পর খুশি হইয়া বিবাহের প্রস্তাব কবুল করত: উক্ত বৈঠকেই বিবাহের দিন তারিখ ধার্য্য করেন। যথা সময়ে দুইটি মহান আত্মার শুভ নিকাহের কাজ সমাপ্ত করিয়া নতুন অতিথিসহ সকলে আনন্দঘন পরিবেশে জুলদা গ্রামের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হন। বিবাহের কিছুদিন অতিবাহিত হওয়ার পর হযরত নজীর ভান্ডার (ক:) তাঁহার কর্মস্থল বার্মার রেঙ্গুন নগরীতে চালিযা যান। বেশ কিছু দিন পর তিনি জানিতে পারিলেন তাঁহার শ্বশুর হযরত মাওলানা ছৈয়দ আমানত উল্ল্যাহ শাহ্ (র:) মাইজভান্ডারী ত্বরীকার অনুসারী। (কিন্তু বিবাহের পূর্বে এই বিষয়ে হযরত নজীর ভান্ডার (ক:) জানা ছিল না।) শ্বশুর তরীকতপন্থী জানতে পারায় হযরত নজীর ভান্ডার (ক:) প্রকাশ বাবা ভান্ডারীর সাথে দেখা করিয়া তাঁহার সাথে বাহাছ করিবার। সিদ্ধান্ত অনুযায়ী তিনি একদা মাইজভান্ডার দরবার শরীফে গমন করেন হযরত গাউসুল আজম মাওলানা ছৈয়দ গোলামুর রহমান শাহ্ আল মাইজভান্ডারীর (ক:) হুজরা শরীফ হইতে অনেক দূরে দাঁড়াইয়া তাঁহাকে দেখার চেষ্টা করিলেন। উপস্থিত আশেকানদের আচার আচরণে সন্তুষ্ট হইতে না পারিয়া তিনি বাবাভান্ডারীর সাথে দেখা না করিয়া গ্রামের বাড়িতে ফিরিয়ে আসেন। উল্লেখ্য যে, তৎকালীন সময়ে যোগাযোগ ব্যবস্থা অনুন্নত থাকায় অধিক পথ পায়ে হাটিয়া চলিতে হইত। চট্টগ্রাম শহর থেকে মাইজভান্ডার দরবার শরীফ যাইতে একদিন সময় লাগিত। অতএব হযরত নজীর ভান্ডার (ক:) দুইদিনের উপবাস ও ক্লান্ত। বাড়ীতে আসিয়া গোসল শেষে আরো ক্লান্ত বোধ করিতে লাগিলেন। তিনি রাতের আহারের পর জায়নামাজেই ঘুমাইয়া পড়েন। হযরত নজীর ভান্ডার (ক:) বর্ণনা করিয়াছেন “আমি স্বপ্নে দেখতে পেলাম এক জ্যোতির্ময় মহাপুরুষকে। আকাশের চন্দ্রের আলোও যেন তাঁহার নূরের কাছে হার মানায়। আমি উঠে দাঁড়িয়ে তাঁকে ভক্তিভাবে কদমবুচি করলাম। আমাকে লক্ষ্য করে তিনি বলতে লাগলেন, আমাকে চিন? আমি এই জামানার মুজাদ্দেদ, গাউসুল আজম মাওলানা ছৈয়দ গোলামুর রহমান শাহ (ক:)। তুমি আমার দরবারে গিয়ে আমার সাথে সাক্ষাত না করে কেন চলে এসেছ? আমার দরবার থেকে কেউ খালি হাতে ফিরে না। তোমার কিসমত খুবই ভাল, আমি তোমাকে ডেকে নিতে এসেছি। তোমার জন্য আল্লাহর কুদরতি শক্তির বেলায়তি একটি পরিপূর্ণ মাত্র রেখেছি। তুমি আমার নিকট হইতে তা গ্রহন করে নিয়ে আস। আমি তোমার অপেক্ষায় আছি।” হযরত নজীর ভান্ডার (ক:) জাগিয়া উঠেন এবং ফজরের নামাজ আদায়ের পর প্রাণপ্রিয় মাশুকের দিদারের উদ্দেশ্যে মাইজভান্ডার দরবার শরীফে রওয়ানা হন। প্রথমে হযরত গাউছুল আজম মাওলানা ছৈয়দ আহমদ উল্লাহ্ আল্ মাইজ ভান্ডারীর (ক:) পাক পবিত্র রওজা শরীফে জিয়ারত করেন, অত:পর হযরত গাউছুল আজম, ইউছুপে ছানী, জামাল মোস্তফা, শাহ্ ছুফী মাওলানা ছৈয়দ গোলামুর রহমান শাহ্ আলম মাইজভান্ডারী (ক:) খেদমতে হাজির হওয়া মাত্রই তাঁর হৃদয়ে নূরানী ঝলক, শুরু হইয়া যায়। তিনি বাবা ভান্ডারীর কেবলা কাবার সামনে উপস্থিত হওয়ার সাথে সাথে তাঁহাকে যেন এক বিশাল কুদরতি চুম্বক টানিয়া বাবা ভান্ডারীর (ক:) পবিত্র কদম শরীফে সেজদায়ে পড়িয়া থাকিলেন। সেজদা হইতে উঠিয়া বাবা ভান্ডারীর (ক:) নূরানী চেহারা মোবারকের দিকে অপলক নেত্রে তাকাইয়া রহিলেন। বাবা ভান্ডার কেবলা কাবা (ক:) তাঁহার পরিধানের চাদরের ভিতর হইতে একটি পাকা কলা তাহার নিজ হাতে হযরত নজীর ভান্ডারীকে খাওয়াইয়া দিলেন। কলাটি খাওয়ার পর হযরত নজীর ভান্ডারী আরো একটি সেজদা আরজ করিলেন। উক্ত কলারূপি তবারুকের মাধ্যমে নেয়ামতে উজমা তথা ফয়েজে এতেহাদি প্রাপ্ত হইয়া দ্বিতীয় সেজদায় খেলাফতের মহান দায়িত্ব প্রাপ্ত হন।
ঐ দিন থেকে তিনি একাধারে ১১ (এগার) দিন বাবা ভান্ডারীর খেদমতে নিয়োজিত ছিলেন। এগার দিন পরে হযর গাউছুল আজম মাওলানা ছৈয়দ গোলামুর রহমান শাহ্ আল্ মাইজভান্ডারী (ক:) বাবাজান কেবলা কাবা সকল খলিফাগণের উপস্থিতিতে ফরমাইয়াছেন- “নজীর-তু-বেনজীর হো গিয়া” তুমি বাড়িতে চলে যাও। এখানে বাবা ভান্ডারী (ক:) হযরত নজীর ভান্ডারী (ক:) কে লক্ষ্য করে যেই কালামটি পেশ করিয়াছেন এরই মাধ্যমে ফয়েজে এতেহাদি ও খেলাফত প্রাপ্তির সাক্ষ্য বহন করে। অত:পর তিনি গ্রামের বাড়িতে ফিরিয়া আসেন। সেখানে কিছুদিন অবস্থানের পর পুনরায় বার্মার রেঙ্গুন নগরিতে তাঁহার কর্মস্থলে যোগদান করেন। একদা বাবা ভান্ডারি কেবলা কাবা তাঁহাকে স্বপ্ন যোগে হুকুম করিলেন- “হে নজীর আহমদ তুমি ত্বরীকত প্রচার কর। তোমার উপর যে মহান দায়িত্ব দেয়া হয়েছে তা পালন কর।” আমিন, ছুম্মা আমিন।
হযরত নজীর ভান্ডারী (ক:) দ্বিতীয় মহা বিশ্ব যুদ্ধের সময় সুদুর বার্মার রেঙ্গুন থেকে পায়ে হেঁটে স্বদেশের উদ্দেশ্যে রওয়ানা দেন। উনার সঙ্গে অনেক ভক্ত, মুরিদান ও সাধারণ জনগণ ছিলেন। ভক্তদের মধ্যে রাউজানের কালামিয়া ফকির বর্ণনা করেন, বাবাজানসহ আমরা বর্তমানে বাংলাদেশের সীমানায় প্রবেশ করে কিছু দূর সামনে আসার পর বিশ্রামের জন্য একটি গাছতলায় সবাই বসিয়া পড়ি। বাবাজান আমাকে বলিলেন, “কালামিয়া আমার পা ফুলে গেছে। ঐ সামনের পাহাড়ে হলুদ গাছ আছে, তুমি আমার জন্য কিছু কাঁচা হলুদ নিয়ে আস।” আমি অনতিবিলম্বে একজন সঙ্গী সহ ঐ পাহাড়ে গিয়ে অনেক খোঁজাখুঁজির পরও কোন হলুদ গাছ না পেয়ে খালি হাতে ফিরে আসিয়া বাবাজানকে আরজ করিলাম- বাবাজান, ঐখানে কোন হলুদ গাছ নাই। এক প্রকারের গাছ দেখিতে পাইলাম যাকে চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষায় ফইল্লা গাছ বলে। তখন বাবাজান পূনরাদেশ করিলেন “তোমরা আবার যাও; আমি ঐখানে হলুদ গাছ দেখিতে পাইতেছি।” তারপর আমরা দুজন সাথে সাথে ঐ পাহাড়ে গিয়ে দেখি ঐ ফইল্লা গাছগুল হলুদ গাছে পরিণত হইয়াছে। ছোবহান আল্লাহ। আমরা বাবাজানের এই আশ্চর্য কেরামত দেখিয়া বিস্মীত হইলাম এবং ঐখান থেকে হলুদ গাছ নিয়ে বাবাজানের খেদমতে হাজির হইলাম। চট্টগ্রাম জেলার রাউজান থানার অন্তর্গত নোয়াজিশপুর গ্রাম নিবাসি কালামিয়া ফকির হযরত নজীর ভান্ডারী (ক:) এর খেলাফত প্রাপ্ত খলিফা ছিলেন। একদা ঐ ফকিরের বাড়ীতে হযরত নজীর ভান্ডার (ক:) সদলবলে সফরে গিয়াছিলেন। ফকিরের বড় ভাইয়ের স্ত্রীর বাবাজানের ভক্ত ছিলেন। উক্ত মহিলা বাবাজানের কাছে ফরিয়াদ করিলেন- বাবাজান আমি অধম একজন নিঃসন্তান, আপনি আমার জন্য দোয়া করুন- আল্লাহ যেন আপনার নজরোকরমে আমাকে সন্তান দান করেন। হযরত নজীর ভান্ডারী (ক:) এ কথা শুনে কিছুক্ষণ চুপ থাকার পর বলে উঠলেন- ‘হে আমার ভক্ত, আল্লাহর রহমতে তোমার গর্ভে পর পর দুটি ছেলে সন্তান হবে এবং আমি সে সন্তানদের নামও নির্বাচন করে দিলাম।’ ১। বড় ছেলের নাম মোহাম্মদ ফজলুল হক, ২। ছোট ছেলের নাম- মোহাম্মদ আবদুল হক। হযরত নজীর ভান্ডারীর (ক:) কালাম অনুযায়ী নির্ধারিত সময়ান্তে ঐ মহিলা দুই ছেলে সন্তানের মা হন। বর্তমানে ঐ ছেলেরা জীবিত আছেন। পবিত্র হাদিছে কুদছী শরীফে আল্লাহ্ তায়ালা ফরমাইয়াছেন- “কালামুল আউলিয়ায়ে কালামুল্লাহ” অর্থ- আউলিয়ায়ে কেরামগণের কালাম বা কথা আল্লাহ পাকের কালাম। অর্থাৎ আল্লাহ্ পাকের আউলিয়াগণের জবানে পাকে যে বাক্য উচ্চারিত হয়, তাহা হাকিকতান আল্লাহ্ পাকে কুদরতী জবানে উচ্চরিত কালাম। প্রতি বছরের ন্যায় এ বছরও ২৯ শে পৌষ ১৩ জানুয়ারি বৃহস্পতিবার ৬২ তম বার্ষিক ওরশ পাঠানটুলী কাপুড়িয়া পাড়া ও ছোটপোল আস্তানা শরীফে ধর্মীয় উৎসাহ উদ্দীপনার মধ্যে দিয়ে ওরশ শরীফ পালিত হবে। সারা দেশ থেকে ঐ দিন অসংখ্য ভক্তরা ওরশে যোগদান করেন।
লেখক: শাহ্জাদায়ে নজীর ভান্ডারী দরবার শরীফ