বিচার বহির্ভুত হত্যাকান্ড গণতন্ত্র ও আইনের পরিপন্থি

এডভোকেট বিপ্লব আচার্য্য # পৃথিবীর বিচার ব্যবস্থার আবির্ভাবের ইতিহাস খুব লম্বা আর এত দীর্ঘ যে, তা পর্যালোচনা করে শেষ করা যাবে না। কিন্তু পৃথিবীতে দেশে দেশে এই বিচার ব্যবস্থার গৌরব নিয়ে নানান গল্প প্রচলিত আছে। তবে কোন দেশের বিচার কতটা নিরপেক্ষ তাই হচ্ছে আধুনিক কালের সমাজ বিশ্লেষণের মুল মাপকাঠি। একদিকে যেমন বিচার ব্যবস্থার গৌরব রয়েছে অন্যদিকে তেমনি এই বিচার ব্যবস্থাকে নিজ নিয়ন্ত্রনে নেওয়ার সংস্কৃতি পৃথিবীর প্রায় সব দেশেই বিদ্যমান। এই অবস্থা থেকে হাতে গোনা কয়েকটি দেশ হয়তো বাইরে আছে। বিচার ব্যবস্থা নিয়ন্ত্রনের এই চেষ্টার কারণে দেশগুলোতে আদিমতা ফিরে আসে বারে বারে।
বহু শতাব্দীর পুরনো রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে যুদ্ধ ছাড়া, মানুষ হত্যার নতুন এক ব্যবস্থা গড়ে উঠেছে গত শতাব্দী থেকে, যার নাম বন্দুকযুদ্ধ। কোনো দেশের সরকার, আইনি ব্যবস্থা কিংবা প্রশাসন ও পুলিশি ব্যবস্থা দুর্বল হয়ে পড়ে তখন আবির্ভাব হয় এই বন্দুক যুদ্ধের।
পাকিস্তানের পতনের আগ দিয়ে কিংবা বাংলাদেশের জন্মের অল্প আগে এক নতুন রাজনৈতিক তত্ত্ব ছড়িয়ে পড়ে বিশ্বব্যাপী, যার নাম শ্রেণি সংগ্রাম। মার্কসীয় অর্থনীতির গর্ভ থেকে জন্ম নেওয়া এই তত্ত্ব কোভিড-১৯ এর মতো চীনের মাও সে তুংয়ের মাথা থেকে ছড়িয়েছিল। এই রাজনৈতিক তত্ত্বের মাধ্যমেই বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের জন্ম। যার প্রভাব হয় সুদূরপ্রসারী রাশিয়ার মতো রাষ্ট্রের প্রলয়ঙ্করি হস্তক্ষেপেও।
বাংলাদেশের জন্মের পর সবচেয়ে বেশি রাজনৈতিক বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ড ঘটায় সর্বহারা পার্টি। সেই ১৯৭২ সাল থেকে ১৯৭৫ পর্যন্ত এই রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ডের ধারাবাহিকতা ব্যাপকতর হয়। সেই পর্যায়ে যতদুর জানা যায় , পাঁচ থেকে সাত জন আওয়ামী লীগের সাংসদ এই হত্যাকাণ্ডের শিকার হন।
পৃথিবীর নানা দেশে মাওয়ের সেই শ্রেনিশত্রু খতমের তত্ত্ব ছড়িয়ে পড়ে।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী সময়ে এশিয়ার হাতে গোনা কয়েকটি দেশ জাপান, তাইওয়ান ছাড়া বাকি সব কটি দেশেই এই বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের ইতিহাস পাওয়া যায়। এশিয়ার বাইরে উত্তর আমেরিকার যুক্তরাষ্ট্রে ও দক্ষিণ আমেরিকার প্রায় সব কটি দেশেই এই বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে। এক্ষেত্রে চ্যাম্পিয়ন দক্ষিন আমেরিকার দেশ চিলি। চিলিতে পিনোশের সময় তিন হাজার ভিন্ন রাজনৈতিক মতের মানুষকে হত্যা করা হয়।
ইউরোপেও, দু একটি দেশ ছাড়া প্রায় সর্বত্র এই বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের পাওয়া যায়।
মজার বিষয় হল যে দেশগুলোতে বিচারিক হত্যাকাণ্ড নিষিদ্ধ(মৃত্যুদন্ড)।সেই দেশগুলোর অনেকগুলোতেই এই বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ড দেখা যায় ।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকেই মূলত রাষ্ট্রগুলোয় বিচার বহির্ভূত এই হত্যাকাণ্ডের পদচারণা বেড়ে যায়। এই হত্যাকাণ্ড যেমন রাজনৈতিক ভিন্ন মতালম্বীদের বিরুদ্ধে দেখা যায় তেমনি রাষ্ট্রের ব্যর্থতার দায়ভার এড়ানোর কৌশলেও পরিনত হয়।
সবচেয়ে বেশি হয় সেই দেশগুলোতে যেখানে গণতন্ত্র দুর্বল অথবা কার্যকারিতার দিক থেকে একবারে শূন্য। ঐসব দেশগুলোর বিচার বিভাগের কর্তৃত্ব সম্পুর্ণ নির্বাহী বিভাগের নিয়ন্ত্রনে। বিচারিক আদালতের সমস্ত বিচারকদের প্রমোশন/বদলী/কর্মস্থল সবই নির্বাহী বিভাগের হাতে থাকে। এমনকি ক্ষেত্র বিশেষে উচ্চ আদালতের প্রধান বিচারপতি নিয়োগ থেকে সব নিয়োগ পুরোপুরি নির্বাহী বিভাগের হাতে থাকে। বিচার বিভাগের এই দুর্বলতার সুযোগে পুলিশি ব্যবস্থা ভেঙ্গে পড়ে। যেমনটি দেখা গেছে দক্ষিন আমেরিকার দেশ গুলিতে।
পৃথিবী ব্যাপী বহু লক্ষ মানুষ শিকার হয়েছে বিচার বহির্ভূত এসব হত্যাকাণ্ডের, নানা সময়ে। এর মধ্য নানা শ্রেনির মানুষ রয়েছে। পৃথিবীব্যাপী এই বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের কারণে কোনো দেশেরই কোন সামাজিক উন্নয়ন ঘটে নাই, মাদক কিংবা সন্ত্রাস মুক্তও হয় নাই ।
আমাদের দেশেও বেশ কিছুকাল এই হত্যাকাণ্ড স্থিমিত হয়েছিল। পুনরায় এর যাত্রা শুরু হয় সম্ভবত ২০০২/২০০৩ সালে নারায়ণগঞ্জের ডেভিড হত্যার ভিতর দিয়ে। এরপর সেই সময় শুরু হয় অপারেশন ক্লিন হার্ট। চলে প্রায় তিন মাস। যে সময় আরও ৫৭ জনের মতো বিচার বহির্ভূত হত্যার শিকার হয়। জন্ম নেয় আরেক নতুন বাহিনীর। নাম হয় জঅই । সেনা বাহিনী ও পুলিশের সমন্বয় গঠিত হয় এই বাহিনী। এই এলিট বাহিনীর বিরুদ্ধে বিচার বহির্ভূত হত্যা ছাড়াও, নারায়ণগঞ্জে সাত খুনের অভিযোগ আছে।
কক্সবাজারের সর্বশেষ ঘটনায় দেশে এক নতুন মাত্রা যোগ হল। প্রাক্তন সেনা কর্মকর্তাদের সংগঠন রাওয়া ক্লাবকে সরাসরি মাঠে নামতে দেখা গেল অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহার মৃত্যুর ঘটনায়।
চলমান এই ক্রসফায়ার একটি শৃঙ্খলযুক্ত বাহিনী পুলিশের প্রতি মানুষের আস্থার ঘাটতি হচ্ছে কিনা বাহিনী নেতৃত্বের সে বিষয় মনোযোগ ও মনযোগী হতে হবে।
টেকনাফের ঘটনার পরও পুলিশ বাহিনী তার শৃঙ্খলা উদ্ধার করতে পারে নাই।
গণমাধ্যমে দেখতে পাই ওসি ক্লোজড কিংবা বদলি- তারপর আর কোন সংবাদ থাকে না।
পরিশেষে বলা যায়,বিচার বহির্ভূত হত্যাকান্ড নিয়ন্ত্রণ করতঃ বাংলাদেশের বিচারব্যাবস্থাকে মর্যাদায় অধিষ্ঠিত করার বিকল্প নেই।

0Shares

নিউজ খুজুন