সাম্প্রতিক রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে বিএনপির স্থায়ী কমিটির বৈঠক পরবর্তী গুলশানে দলের চেয়ারপারসনের কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য খন্দকার মোশাররফ হোসেন বলেন, আগামী ডিসেম্বরের মধ্যে জাতীয় সংসদ নির্বাচন আয়োজনের আবারও দাবি জানিয়েছে বিএনপি। এ লক্ষ্যে নির্বাচনের রোডম্যাপ ঘোষণা না করলে বিএনপির পক্ষে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রতি সহযোগিতা অব্যাহত রাখা কঠিন হয়ে দাঁড়াবে।
খন্দকার মোশাররফ হোসেন বলেন, ‘জুলাই গণঅভ্যুত্থানের আকাঙ্ক্ষা ধারণ করে মানুষের হারানো গণতান্ত্রিক অধিকার, সাংবিধানিক অধিকার, মানবাধিকারসহ ভোটাধিকার নিশ্চিত করার লক্ষ্যে শিগগির জনআকাঙ্ক্ষা অনুযায়ী একটি নির্বাচিত রাজনৈতিক সরকার প্রতিষ্ঠা করাই এখন সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার। তাই, আমরা একটি সুষ্ঠু, অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে ডিসেম্বর ২০২৫ এর মধ্যে একটি জাতীয় সংসদ গঠনের জন্য অবিলম্বে সুনির্দিষ্ট রোডম্যাপ ঘোষণার দাবি জানাচ্ছি।’ এই সর্বোচ্চ জনআকাঙ্ক্ষাকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দেওয়া বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধানতম এজেন্ডা হওয়া উচিত বলে জনগণ মনে করে। এর অন্যথা হলে জনগণের দল হিসেবে বিএনপির পক্ষে এই সরকারের প্রতি সহযোগিতা অব্যাহত রাখা কঠিন হয়ে দাঁড়াবে।’
এসময় গণমাধ্যমকর্মীদের উদ্দেশ্যে বিএনপির এ নেতা বলেন, ‘যে বিষয়গুলো এই সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে আপনাদের সামনে উপস্থাপন করা হচ্ছে, সে বিষয়গুলো আমাদের আগের প্রস্তাব ও পরামর্শের মতো উপেক্ষিত হলে তা হবে দুর্ভাগ্যজনক। সেক্ষেত্রে অনিবার্যভাবেই বিএনপি অন্তর্বর্তী সরকারকে সহযোগিতা অব্যাহত রাখবে কি না- তা পুনর্বিবেচনা করতে বাধ্য হবে।’
ঐক্যের স্বার্থে সর্বোচ্চ নিরপেক্ষতা বজায় রাখতে অন্তর্বর্তী সরকার ব্যর্থ হয়েছে উল্লেখ করে খন্দকার মোশাররফ হোসেন বলেন, ‘ফ্যাসিবাদী আওয়ামী দুঃশাসনের পতন হয়েছে, বিজয়ী হয়েছে ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থান। কিন্তু গত সাড়ে ৯ মাসে জনপ্রত্যাশা বা গণঅভ্যুত্থানের আকাঙ্ক্ষা কতটুকু এর মধ্যে পূরণ হয়েছে তা এক বিশাল প্রশ্নের সম্মুখীন। ফ্যাসিবাদ বিরোধী জাতীয় ঐক্যে ফাটল ধরতে শুরু করেছে।’ ‘আগামীর বাংলাদেশের মূল চালিকাশক্তি এই ঐক্যকে বজায় রেখে একটি শক্তিশালী গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ বিনির্মাণের কোনো বিকল্প নেই। এই ঐক্যের স্বার্থে অন্তর্বর্তী সরকারকে সর্বোচ্চ নিরপেক্ষতার অবস্থান বজায় রাখার কথা ছিল। কিন্তু লক্ষ্য করা যাচ্ছে যে, কোনো কোনো মহলের রাজনৈতিক ফায়দা হাসিলের এজেন্ডা বাস্তবায়ন করাই যেন সরকারের কর্মপরিকল্পনার অংশ হয়ে দাঁড়িয়েছে। অন্তর্বর্তী সরকারের সাম্প্রতিক কিছু কর্মকাণ্ডে সরকারের নিরপেক্ষতা নিয়ে জনমনে সংশয় সৃষ্টি হয়েছে।’
অন্তর্বর্তী সরকারের নিরপেক্ষতা বজায় রাখার স্বার্থে বিতর্কিত কয়েকজন উপদেষ্টা- যাদের বক্তব্যে এবং কর্মকাণ্ডে সরকারের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হচ্ছে, এমন বিতর্কিত উপদেষ্টাদের সরিয়ে দেওয়ার দাবি আমরা তুলেছিলাম। অন্তর্বর্তী সরকারের যেসব উপদেষ্টা একটি নুতন রাজনৈতিক দলের সঙ্গে প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষভাবে জড়িত বলে সবাই জানে ও বুঝে, উপদেষ্টা পরিষদে তাদের উপস্থিতি সরকারের র্নিদলীয় নিরপেক্ষ পরিচিতিকে ক্রমাগত প্রশ্নবিদ্ধ করে চলেছে। ফলে সরকারের ভাবমূর্তি রক্ষার্থে তাদের অব্যাহতি দেওয়া প্রয়োজন।’
তিনি বলেন, ‘জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টার গতকালকের বক্তব্য আবারও নতুন বির্তকের জন্ম দিয়েছে। সরকারের ভাবমূর্তি রক্ষার্থে তাকে অব্যাহতি দিতে হবে। ফ্যাসিবাদের দোসর কয়েকজন উপদেষ্টাকে সরিয়ে দেওয়ার দাবি আমরা এর আগে অনেকবার উত্থাপন করেছি। যেহেতু একটি জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠান করাই এই সরকারের প্রধান কাজ, তাই মাথাভারী উপদেষ্টা পরিষদ না রেখে শুধুমাত্র রুটিন ওয়ার্ক (দৈনন্দিন কার্যক্রম) পরিচালনার জন্য ছোট আকারের উপদেষ্টা পরিষদ রাখাই বাঞ্ছনীয়।’
অন্তর্বর্তী অস্থায়ী সরকারের একমাত্র ম্যান্ডেট হচ্ছে একটি সুষ্ঠু, অবাধ ও নিরপেক্ষ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠান করা মন্তব্য করে বিএনপির এ নেতা বলেন, ‘অথচ সরকারের মুখপাত্র হিসেবে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব বলেছেন যে- এই সরকারের সবকিছু করার ম্যান্ডেট রয়েছে।’
মানবিক করিডর এবং চট্টগ্রাম বন্দর নিয়ে সরকারের বিভিন্ন বক্তব্য ও কর্মকাণ্ডে জাতীয় স্বার্থ রক্ষিত হচ্ছে কি না সেটা সর্বাগ্রে বিবেচনায় নেওয়ার দাবি জানায় বিএনপি। এছাড়াও এমন জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ ও দীর্ঘমেয়াদি নীতি নির্ধারণী কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়ার এখতিয়ার অন্তর্বর্তী অস্থায়ী সরকারের আছে কি না- সেই প্রশ্ন তুলেছে দলটি। দেশের নিরাপত্তা সংশ্লিষ্ট স্পর্শকাতর ও জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার বিবেচনায় নিয়ে যাতে দেশে অস্থিতিশীল কোনো পরিবেশ সৃষ্টি না হয় সেদিকে লক্ষ্য রাখার পরামর্শ দেয় দলটি। ‘রাজনৈতিক দলগুলোর ঐকমত্যের ভিত্তিতে একটি সংস্কার সনদ তৈরির প্রক্রিয়ার মধ্যেই আলাপ-আলোচনা অব্যাহত থাকা সত্ত্বেও একই বিষয়গুলো নিয়ে এবং স্থানীয় সরকার নির্বাচনের দাবিতে একটি দলের নির্বাচন কমিশন ঘেরাও কর্মসূচি আমাদের এবং সরকারকে বিব্রত করে।’ ‘সার্চ কমিটির মাধ্যমে আইন অনুযায়ী নির্বাচন কমিশন গঠিত হলেও একটি মহল নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠন চায়। সরকার সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান সমূহ পুনর্গঠনের প্রক্রিয়ায় সব ক্ষেত্রে আমাদের মতামত না নিলেও নির্বাচন কমিশন গঠনের ক্ষেত্রে সব পক্ষকে অন্তর্ভুক্ত করে এই কমিশন গঠন করেছে। কিন্তু ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র সংক্রান্ত বিষয়ে আদালতের রায় অনুযায়ী গেজেট নোটিফিকেশন করায় নির্বাচন কমিশনকে অন্যায় ও অযৌক্তিকভাবে প্রশ্নবিদ্ধ করা হচ্ছে। আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার জন্যই দেশের জনগণ রক্ত দিয়ে গণঅভ্যুত্থান করেছে। সুতরাং আমাদের আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় দৃঢ় সংকল্পবদ্ধ থাকতে হবে। আমরা আশা করবো নির্বাচনী ট্রাইব্যুনাল এবং উচ্চ আদালতের রায়ের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করে অতি শিগগির সরকার ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র হিসেবে ইশরাক হোসেনকে শপথ গ্রহণ করানোর ব্যবস্থা নেবে।’
সাম্প্রতিক সময়ে লক্ষ্য করা যাচ্ছে যে, জনআকাঙ্ক্ষা অনুযায়ী সরকারের যা করণীয় তা যথাসময়ে না করে চাপের মুখে করার সংস্কৃতি এরই মধ্যে সরকারের সক্ষমতা ও মর্যাদা ক্ষুণ্ন করেছে। অন্যদেরও একই প্রক্রিয়ায় দাবি আদায়ের ন্যায্যতা প্রদান করেছে। এই অনভিপ্রেত ও বিব্রতকর পরিস্থিতির দায় পুরোটাই সরকারের বলে আমরা মনে করি।’ ‘নির্বাচন কমিশনের সাংবিধানিক দায়িত্ব হচ্ছে রাষ্ট্রপতি নির্বাচন ও জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠান করা। এমন বাস্তবতায় স্থানীয় সরকার নির্বাচনের দাবিতে নির্বাচন কমিশন ঘেরাও করার বিষয়টি উদ্দেশ্যমূলক ও রহস্যজনক।’
ফ্যাসিবাদী শক্তির বিচারকাজ চলমান থাকবে জানিয়ে খন্দকার মোশারফ বলেন, ‘যেহেতু সংস্কার একটি চলমান প্রক্রিয়া, তাই সংস্কার ও নির্বাচন প্রক্রিয়া দুটোই একই সঙ্গে চলতে পারে। পতিত ফ্যাসিবাদী শক্তির এবং ব্যক্তির অর্থাৎ দল এবং মানবতাবিরোধী অপরাধে অভিযুক্ত ব্যক্তিদের বিচার প্রক্রিয়া চলমান থাকবে।
সংবাদ সম্মেলনে আরও উপস্থিত ছিলেন- বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আব্দুল মঈন খান, আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী এবং সালাউদ্দিন আহমেদ।