জাতিকে সামনে এগিয়ে নিতে সীসাঢালা প্রচীরের মতো ঐক্য লাগবে জানিয়ে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর আমীর ডা. শফিকুর রহমান বলেছেন, আমি বিনয়ের সাথে বলবো এমন কোন হটকারী কাজ করবেন না; যার কারণে আমাদের জাতীয় ঐক্য নষ্ট হয়। আমরা যেন কেউ চুরি-চামারি না করি। চাঁদাবাজি না করি, দখল বাণিজ্য না করি, মামলা বাণিজ্য না করি। ফ্যাসিস্টদের যেন কোনরকম আশ্রয়-প্রশ্রয় প্রদান না করি।
২৪ জানুয়ারি কুড়িগ্রাম সরকারি কলেজ মাঠে কুড়িগ্রাম জেলা জামায়াত আয়োজিত বিশাল কর্মী সম্মেলনে প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এসব কথা বলেন। কর্মী সম্মেলনে সভাপতিত্ব করেন জেলা আমীর মাওলানা আবদুল মতিন ফারুকী। জেলা সেক্রেটারি মাওলানা নিজাম উদ্দিনের সঞ্চালনায় বিশেষ অতিথির বক্তব্য রাখেন বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল ও রংপুর-দিনাজপুর অঞ্চল পরিচালক মাওলানা আবদুল হালিম, কেন্দ্রীয় কর্মপরিষদ সদস্য ও রংপুর-দিনাজপুর অঞ্চলের সহকারী পরিচালক অধ্যক্ষ মাওলানা মমতাজ উদ্দিন, অঞ্চল টিম সদস্য অধ্যাপক মাহবুবুর রহমান বেলাল, কুড়িগ্রাম জেলার সাবেক আমীর আজীজুর রহমান, ব্যারিস্টার মাহবুব আলম সালেহী ও রংপুর মহানগর আমীর এটিএম আজম খান। এর আগে ক্বারী আব্দুল্লাহ আল আমীনের অর্থসহ কোরআন তেলাওয়াতের মাধ্যমে সম্মেলন শুরু হয়। সংগীত পরিবেশন করে ধরলা শিল্পী গোষ্ঠি ও কুড়িগ্রাম কালচারাল একাডেমি।
প্রধান অতিথির বক্তব্যে ডা. শফিকুর রহমান বলেন, ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি থেকে ২০২৫ সালের ২৪ জানুয়ারি পর্যন্ত দীর্ঘ পরিক্রমায় বিভিন্ন ধর্মের মানুষের ওপর কারা জুলুম অত্যাচার করেছে, কারা তাদের জমিগুলো দখল করেছে, ভিটে মাটি থেকে উচ্ছেদ করেছে, সম্পদ লুণ্ঠন করেছে, তাদের ইজ্জতে হাত দিয়েছে, এই দুষ্কৃতিকারীদের তালিকা করে জনগণের সামনে প্রকাশ করে দেওয়া হোক। আমার দ্বারাও যদি এ কাজ সংঘটিত হয়ে থাকে, তবে আমার নামও প্রকাশ করা হোক। বাংলাদেশের জনগণ জানুক এরা কারা। আপনাদের বৃহত্তর রংপুরের পীরগঞ্জের মৎস্যপল্লীতে গরু চুরি করে কারা ঘরবাড়িতে আগুন দিয়েছিল, তা আপনারা জানেন। যুবলীগ নেতার নেতৃত্বে এই অপকর্ম করা হয়েছিল। দিনাজপুরের সাঁওতাল পল্লী, বি-বাড়িয়ার অমুসলিম ভাইদের ওপর হামলা, ঘরবাড়ি লুণ্ঠন এবং অগ্নিসংযোগ, রামুতে বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের মঠ ভাঙচুর করা, ঘরবাড়িতে হামলা এবং অগ্নিসংযোগ করা; এই সকল অপকর্মের সাথে আওয়ামী লীগের দুর্বৃত্তরা জড়িত ছিল। কিন্তু সব কিছুর জন্য জামায়াতে ইসলামীকে দায়ি করা হয়। আপনারাই সাক্ষী- গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জের সাবেক এমপি লিটনকে তার বাড়ির কাছে কে বা কারা শুট করে হত্যা করল। তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী সংসদে দাঁড়িয়ে বললেন, একাজ জামায়াত-শিবির করেছে। সেখানে তান্ডব চালানো হলো। আমাদের নিরীহ নেতাকর্মীদের গ্রেফতার করে রিমান্ডে নিয়ে শারীরিক, মানসিক, আর্থিক নির্যাতন করা হলো। আমরা বললাম এ ধরনের নাপাক কাজ আমরা করি না, আমরা করি নাই। দিন শেষে দেখা গেল একাজের সাথে জামায়াতে ইসলামীর কোনো ধরনের সম্পর্ক ছিল না। বরঞ্চ তাদেরই ক্ষমতার পার্টনার একজন সাবেক কর্নেল ঐ আসনের যিনি সাবেক এমপি ছিলেন তিনি তার ভবিষ্যত রাস্তা পরিষ্কার করার জন্য একাজ করেছেন। বিচারে প্রমাণিত হলো তিনিই খুনি।
আমরা আর পিছনে তাকাতে চাই না। জাতি সামনে আগাতে চায়। জাতিকে সামনে এগুতে হলে জাতির সীসাঢালা প্রাচীরের ঐক্য লাগবে। তিনি জাতিকে আশ্বস্ত করে বলেন, আমরা প্রতিহিংসার পক্ষে না। তবে খুনীদের মাফ নাই। প্রত্যেকটা খুনের বিচার হতে হবে।
তিনি উদাহরণ টেনে বলেন, আল্লাহর রাসূল (সা.) মক্কা বিজয়ের সময় সমস্ত দুশমনদের ক্ষমা করে দিয়েছিলেন। তিনি বলেছিলেন, আজকে সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করা হলো। কিন্তু যারা নিরীহ মানুষকে খুন করেছে, রাসূল (সা.) তাদের দশ বা তেরজনের নাম উল্লেখ করে বলেছিলেন, এদের যেখানে পাও সেখনেই খুন করো। খুন কখনো মাফ হয় না। আমরা বাংলাদেশের প্রত্যেকটা খুনের বিচার চাই। শুধু আমাদের নেতা কর্মী না। অন্যায়ভাবে যত মানুষ খুন করা হয়েছে, আমরা সব খুনের বিচার চাই।
ডা. শফিকুর রহমান বলেন, বৃহত্তর রংপুরবাসী আপনারা অনেক কারণেই গর্বিত। অথচ আপনারা বঞ্চিত। এই রৌমারীর বড়াই বাড়িতে যে যুদ্ধটা আপনারা অন্ধকারে করে শিক্ষাটা দিয়েছিলেন; সেই যুদ্ধের প্রতিশোধ নেওয়া হয়েছে বিডিআরের পিলখানা হত্যাকাণ্ডের মাধ্যমে।
দীর্ঘ সাড়ে ১৫ বছরে ফ্যাসিজমকে বিদায় করতে গিয়ে একজন মানুষ শুধু বাংলাদেশের ইতিহাসে নয়, বিশ্বেরর ইতিহাসে তার সোনালি নামটা লেখা হয়ে গেছে। এই সন্তানটাও বৃহত্তর রংপুরের। তিনি উপস্থিত জনতার দিকে প্রশ্ন রেখে বলেন, তার নাম কি? মাঠ থেকে জবাব আসে ‘আবু সাঈদ’। সে এখন আমাদের বিপ্লবের আইকন। আমাদের প্রতীক, আমাদের সিপাহশালার। আমাদের বীর সেনাপতি। তার রাস্তা ধরে যারাই জীবন দিয়েছে তাদের শহীদ হিসেবে কবুলের দোয়া করি। তাদেরকে যেন আমরা শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করতে পারি, সম্মানের সাথে বুকে ধারণ করতে পারি। শহীদ এবং পঙ্গুদের কাছে আমরা কৃতজ্ঞ। এ ঋণ পরিশোধ করার শক্তি এ জাতির নেই। তবে যে কারণে তারা শহীদ হয়েছেন, আমরা তাদের আমাদের প্রিয় সংগঠনের পক্ষ থেকে কথা দিচ্ছি, একটা দুর্নীতি মুক্ত, সুষম বৈষম্যহীন-মানবিক বাংলাদেশ না গড়া পর্যন্ত আমাদের লড়াই অব্যাহত থাকবে ইনশা আল্লাহ। তিনি আবারো উচ্চারণ করেন, ‘আবু সাঈদ মুগ্ধ, শেষ হয়নি যুদ্ধ’। যুদ্ধ সেদিন শেষ হবে মানবিক বাংলাদেশ যেদিন প্রতিষ্ঠিত হবে। তার আগ পর্যন্ত যুদ্ধ চলবে। আমরা সমাজে অনাচার দেখলে প্রতিবাদ করবোই।
তিনি বলেন, এটা আমার বিরুদ্ধে হলেও আমি প্রতিবাদ করবো। অনাচার যিনি করবেন তার ব্যাপারে আমরা মুখ বন্ধ করে থাকবো না। সেজন্যই আমরা রাজনীতি করি। আমরা ন্যায়ের পক্ষ নেবো, অন্যায়ের প্রতিবাদ করবো। যদি অন্যায় নিরবে হজম করি তাহলে আমিও অন্যায়কারীর মদদদাতা হয়ে গেলাম। আমরা এই অপকর্মের দায় নিতে চাই না। এমনকি আমাদের দলের কেউ যদি এমনটা করে তাহলে বলবো তাদেরকে ধরেন, ছাড় দিবেন না। আমাদেরকে খবর দিবেন প্রশাসনকেও খবর দিবেন। এদের ব্যাপারে আমাদের জিরো টলারেন্স।
তিনি চ্যালেঞ্জ দিয়ে বলেন, আপনারা সাক্ষী ৫ আগস্ট থেকে আজকে জানুয়ারি মাসের ২৪ তারিখ পর্যন্ত দীর্ঘ ৬ মাসের পথ পরিক্রমায় জামায়াতের লোকেরা চাঁদাবাজি করে নাই। দখল বাণিজ্য করেনি। শত শত মানুষকে মামলায় ফেলে তাদের কাছ থেকে টাকা আদায় করেনি। ঘুষের ভাগাভাগি করেনি।
তিনি সবাইকে অনুরোধ করে বলেন, দয়া করে শহীদদের আকাঙ্ক্ষার বিরুদ্ধে যায় এমন কাজ করবেন না। তিনি বন্ধু, দোস্ত সম্বোধন করে বলেন, দয়া করে চাঁদাবাজি দখলবাজি করবেন না। এরপরও যদি কেউ অপকর্ম অব্যাহত রাখেন; মনে রাখবেন আমাদের লড়াইও অব্যাহত থাকবে।